যিলহজ : মুমিনের বিরাট প্রাপ্তির মাস
শায়খ ফজলুর রহমান কাসিমি হাফিযাহুল্লাহ
আল্লাহ রাব্বুল আলীমন কর্তৃক ঘোষিত একটি পবিত্র মাসে একজন মুমিনের অনেক প্রাপ্তি থাকে। শুধু মাস নয়; দিন, রাত, ঘণ্টা এমনকি একটি বিশেষ মুহূর্তকেও যদি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র ও ফযিলতপূর্ণ বলে ঘোষণা করে দেন, তাহলে তাতে আল্লাহপ্রেমী একজন মুমিনের জন্য অনেক কিছু পাওয়ার থাকে, যাকে সে কোনোভাবেই অবহেলা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতে পারে না এবং অবমূল্যায়ন করে সে সময়গুলোকে হেলায় ফেলায় কাটিয়ে দিতে পারে না। বরং ওই সময়গুলোর সর্বোচ্চ মূল্যায়নই তার কাছে কাম্য।
এক্ষেত্রে একজন মুমিনকে প্রথমে যে কাজটি করতে হবে তা হল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে ওই দিনগুলোর কী ফযিলত ঘোষণা করা হয়েছে তা জানা। দ্বিতীয়ত ওই দিনগুলোতে কী কী করতে বলা হয়েছে এবং কী কী করতে নিষেধ করা হয়েছে তা জানা। তৃতীয়ত প্রথাগত কিছু কাজ, যা কোনো কোনো এলাকার লোকজন যুগের পর যুগ ধরে পালন করে আসছে, শরিয়তে যার কোনো ভিত্তি নেই, সেসব কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং অন্যদেরকেও দূরে রাখতে চেষ্টা করা।
এ নিবন্ধে যিলহজ মাসের এ ধরনের মৌলিক কয়েকটি বিষয় নিয়ে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সঠিক ও উপকারী কথাগুলো পেশ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
যিলহজ মাসের ফযিলতপূর্ণ কিছু আমল
যিলহজ মাসের সর্বাধিক ফযিলতপূর্ণ আমল হল, হজ পালন করা। দ্বিতীয় পর্যায়ে ফযিলতপূর্ণ আমল হল, কুরবানি করা। তৃতীয় পর্যায়ে, যিলহজের প্রথম দশটি দিন হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন আমলের মধ্যে কাটানো।
১ম আমল : হজ করা
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন-
وَلِلّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ الله غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য বাইতুল্লাহর হজ করা সেসব মানুষের ওপর কর্তব্য, যারা বাইতুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ রাখে। কেউ কুফরি করলে (তার জানা উচিত,) আল্লাহ সৃষ্টিকুল থেকে সম্পূর্ণ অমুখাপেক্ষী। -সূরা আল ইমরান (০৩) : ৯৭
আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَنْ حَجَّ لِلَّهِ فَلَمْ يَرْفُثْ، وَلَمْ يَفْسُقْ، رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّه
যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করবে এবং হজ করতে গিয়ে কোনো প্রকার অশ্লীলতা ও গুনাহে লিপ্ত হবে না, সে হজ থেকে সে দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে, যে দিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছেন। সহিহ বুখারি : ১৫২১
২য় আমল : কুরবানি করা
আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
مَا عَمِلَ آدَمِيٌّ مِنْ عَمَلٍ يَوْمَ النَّحْرِ أَحَبَّ إِلَى اللهِ مِنْ إِهْرَاقِ الدَّمِ، إِنَّهُ لَيَأْتِي يَوْمَ القِيَامَةِ بِقُرُونِهَا وَأَشْعَارِهَا وَأَظْلاَفِهَا، وَأَنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللهِ بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ مِنَ الأَرْضِ، فَطِيبُوا بِهَا نَفْسًا.
কুরবানির দিন আল্লাহর কাছে (কুরবানির পশুর) রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে অধিক প্রিয় কোনো আমল আদম সন্তান করতে পারে না। কুরবানির পশু তার শিং, পশম, খুর নিয়ে কেয়ামতের দিন হাজির হবে। আর কুরবানির পশুর রক্ত যমিনে পড়ার আগে আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা আনন্দচিত্তে কুরবানি করো। -সুনানে তিরমিজি : ১৪৯৩
৩য় আমল : প্রথম নয় দিন, বিশেষভাবে আরাফার দিন রোযা রাখা
যিলহজের প্রথম দশ দিনের ফযিলত ও তাতে করণীয় বিভিন্ন আমলের কথা বেশ কিছু হাদীসে এসেছে। নিম্নে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হল,
আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
مَا مِنْ أَيَّامٍ العَمَلُ الصَّالِحُ فِيهِنَّ أَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ العَشْرِ، فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، وَلاَ الجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَلاَ الجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ.
এমন কোনো দিন নেই, যে দিনের নেক আমল আল্লাহ তাআলার নিকট যিলহজ মাসের এই দশ দিনের নেক আমল অপেক্ষা অধিক প্রিয়। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তাআলার পথে জিহাদ করাও কি (এত প্রিয়) নয়? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আল্লাহ তাআলার পথে জিহাদও তার চেয়ে বেশি প্রিয় নয়। তবে জান-মাল নিয়ে যদি কোনো লোক আল্লাহ তাআলার পথে জিহাদে বের হয় এবং যদি সে এ দুটির কোনোটিই নিয়ে আর ফিরে না আসতে পারে, তার কথা (অর্থাৎ সেই শহীদের মর্যাদা) আলাদা। -সুনানে তিরমিজি : ৭৫৭
অপর এক বর্ণনায় এ হাদীসের শেষাংশে আরও বর্ণিত হয়েছে,
فَأَكْثِرُوا فِيهِنَّ مِنَ التَّسْبِيحِ وَالتَّهْلِيلِ وَالتَّكْبِيرِ وَالتَّحْمِيدِ
সুতরাং তোমরা এ দিনগুলোতে অধিক পরিমাণ সুবহানাল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করো। -মুসনাদে আব্দ ইবনি হুমায়দ : ৮০৭
এক হাদীসে এসেছে,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجَّةِ، وَيَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَثَلَاثَةَ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، أَوَّلَ اثْنَيْنِ مِنَ الشَّهْرِ وَالْخَمِيسَ
রাসুলুল্লাহ ﷺ যিলহজ মাসের নয়দিন রোজা রাখতেন…। –সুনানে আবি দাউদ : ২৪৩৭
যিলহজের এ দিনগুলোর এত ফযিলতের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাফেয ইবনে হাজার রহ. বলেন-
والذي يظهر أن السبب في امتياز عشر ذي الحجة لمكان اجتماع أمهات العبادة فيه وهي الصلاة والصيام والصدقة والحج ولا يتأتى ذلك في غيره . فتح الباري لابن حجر رحمه الله
“যিলহজের দশ দিনের এ বৈশিষ্টের যে কারণ প্রতিভাত হয়, তা হচ্ছে, এ দিনগুলোতে মৌলিক ইবাদতগুলোর মিলন ঘটে। যথা নামাজ, রোজা, সাদাকা, হজ। আর এতগুলো মৌলিক ইবাদত এ দিনগুলো ব্যতীত অন্য কোনো দিনে একসাথে হয় না।” -ফাতহুল বারী, হাফেয ইবনে হাজার
আরাফার দিনের রোযা
আবু কাতাদা আনসারি রাযি. বর্ণনা করেন,
وَسُئِلَ عَنْ صَوْمِ يَوْمِ عَرَفَةَ؟ فَقَالَ: «يُكَفِّرُ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ وَالْبَاقِيَةَ»
রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আরাফার দিনের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তখন তিনি বললেন, তা অতীত এক বছরের এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহ মোচন করে দেবে। -সহিহ মুসলিম : ১১৬২
তবে হাজীদের জন্য এ দিন রোজা রাখার অনুমতি নেই। কারণ, হজের সকল আমলের মধ্যে আরাফার ময়দানে অবস্থান করা তুলনামূলক একটু কঠিন আমল। তাই এ দিন রোজা রাখলে শারীরিক দুর্বলতার কারণে এ দিনের অন্যান্য আমলে ঘাটতি দেখা দিতে পারে বা তা অনেক কষ্টকর হয়ে যেতে পারে।
হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ صَوْمِ يَوْمِ عَرَفَةَ بِعَرَفَةَ
রাসূলুল্লাহ ﷺ আরাফার ময়দানে আরাফার দিনের রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। সুনানে আবি দাউদ : ২৪৪০
অর্থাৎ, আরাফার দিনের মহান ফযিলতপূর্ণ রোজাটি সেসব ব্যক্তিদের জন্য, যারা সে দিন আরাফার ময়দানে অবস্থান করছেন না। আর যারা হজ পালনের উদ্দেশ্যে আরাফার ময়দানে অবস্থান করছেন, তাদের জন্য এ রোজা নয়।
৪র্থ আমল : তাশাব্বুহ বিল ইহরাম বা নখ, চুল ও শরীরের কোনো পশম না কাটা
যারা হজে যাননি, হাজীদের ইহরামের অনুকরণে তাদের কিছু আমল করার কথা হাদীসে এসেছে। বিশেষত যারা কুরবানি করবেন, তাদের জন্য এ আমল। হাজীদের এহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষেধ, সে ধরনের কিছু কাজ কুরবানি করতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিদের জন্যও নিষেধ করা হয়েছে। তবে এ নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা একটি মুস্তাহাব আমল। মেনে না চললে কোনো গুনাহ নেই। হাদীসে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে এ আমল অবশ্যই ফযিলতপূর্ণ একটি আমল।
উম্মে সালামা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِذَا دَخَلَتِ الْعَشْرُ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلَا يَمَسَّ مِنْ شَعَرِهِ وَبَشَرِهِ شَيْئًا
যিলহজের দশ দিন শুরু হলে তোমাদের যারা কুরবানি করার ইচ্ছা করেছে, তারা যেন তাদের চুল বা শরীরের কোনো পশম না ফেলে। সহিহ মুসলিম : ১৯৭৭
একই বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে নখ না কাটার কথাও এসেছে,
وَلَا يَقْلِمَنَّ ظُفُرًا
… তারা যেন তার নখও না কাটে। সহিহ মুসলিম : ১৯৭৮
এ দিনগুলোতে বর্জনীয় কিছু কাজ
১. আরাফা উদযাপন
আরাফার দিনে উকূফে আরাফার সময়ে আরাফার ময়দানের বাইরে আরাফার আদলে সময় কাটানো। অর্থাৎ যারা হজ করছেন না, তারা হজ পালনকারীদের মতো সময় কাটানো। আরবী পরিভাষায় এ আমলকে التعريف (তা’রীফ) বলা হয়।
এর একটি সুরত হচ্ছে, উকূফে আরাফার সময় অনুযায়ী যেকোনো জায়গায় একাকী বা কয়েকজন একত্রিত হয়ে দুয়া ও কান্নাকাটি করা। এ আমলটিকে কেউ কেউ উত্তম বলেছেন, আবার কেউ কেউ বিদআত ও মাকরূহ বলেছেন।
উপরিউক্ত সুরত ব্যতীত এর আরও কিছু সুরত রয়েছে, যেগুলো বিদআত হওয়ার বিষয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। সেসব সুরতের মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে :
১. এ আমলের জন্য কোনো একটি জায়গাকে নির্দিষ্ট করে নেওয়া এবং সেখানে উপস্থিত হয়ে আরাফা উদযাপন করা।
২. শহরের সবচাইতে বড় মসজিদটিকে এ আমলের জন্য নির্দিষ্ট করে নেওয়া।
৩. শহরের সবচাইতে বড় ময়দানটিকে এ আমলের জন্য নির্দিষ্ট করে নেওয়া।
৪. পৃথিবীর বিশেষ কোনো মসজিদকে এ আমলের জন্য নির্দিষ্ট করে সেখানে সফর করে যাওয়া।
৫. মানুষকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ ক