যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার পর পালনীয় একটি সুন্নাহ : কিছু জিজ্ঞাসার জবাব
মুফতি আবু আসেম নাবিল (হাফিযাহুল্লাহ)
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على خاتم النبيين، وعلى آله وصحبه أجمعين، و من تبعهم بإحسان إلى يوم الدين
যিলহজ্ব মাসে ফরয হজ্ব ছাড়াও কুরবানী, আরাফা দিবসের সিয়াম, তাকবীরে তাশরীক ইত্যাদী ওয়াজিব, সুন্নত ও নফল পর্যায়ের কয়েকটি মৌলিক ইবাদত পালন করতে হয়। এ সকল আমলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত আমল হল, যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা।
যিলহজ্ব মাসের সূচনালগ্নে উক্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজের দ্বীনদার মহলে কিছু জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়। যেমন-
১. যারা কুরবানী দিতে ইচ্ছুক, তাদেরকে যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকতে হবে। (যেমনটা সহীহ মুসলিমের ১৯৭৭ নং হাদীসে এসেছে)
২. কিন্তু যারা সামর্থ্য না থাকার কারণে কুরবানী দিতে ইচ্ছুক নয়, তাদের করণীয় কী?
৩. আর কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তি যদি চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকতে চায়, তাহলে সে কবে থেকে বিরত থাকবে?
৪. কুরবানীদাতা তার চুল-নখ ইত্যাদি পরবর্তীতে কখন কাটতে পারবে?
৫. নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকার বিধানটা কি ওয়াজিব, নাকি মুস্তাহাব পর্যায়ের?
৬. যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকে সাধারণ মুমিনদের জন্য চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা, এটা হাজ্বীদের কর্মের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কি না?
যিলহজ্ব মাসের নতুন চাঁদ উদিত হওয়ার আগে-পরে উক্ত বিষয়গুলো নিয়ে দ্বীনদার মহলে ব্যাপক জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়। তাই উক্ত বিষয়গুলো নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা তুলে ধরা হলো-
১. যারা কুরবানী করবে তাদের জন্য যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত চুল-নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা সুন্নত।
এ বিষয় উম্মে সালামা রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ رَأَى هِلَالَ ذِي الْحِجَّةِ فَأَرَادَ أَنْ يُضَحِّيَ فَلَا يَأْخُذْ مِنْ شَعْرِهِ وَلَا مِنْ أَظْفَارِهِ حَتَّى يُضَحِّيَ. (هذا لفظ النسائي، و لفظ مسلم “مَنْ كَانَ لَهُ ذِبْحٌ يَذْبَحُهُ فَإِذَا أُهِلَّ هِلَالُ ذِي الْحِجَّةِ، فَلَا يَأْخُذَنَّ مِنْ شَعْرِهِ، وَلَا مِنْ أَظْفَارِهِ شَيْئًا حَتَّى يُضَحِّيَ”).
যে ব্যক্তি যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখবে এবং কুরবানী করার ইচ্ছা করবে, সে যেন কুরবানী করা পর্যন্ত তার চুল ও নখের কোনো কিছু না কাটে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৭; সুনানে নাসাঈ ৭/২১১-২১২, তাহকীক- আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.; সুনানে তিরমিযি, হাদীস ১৫২৩; ইমাম তিরমিযি রহ. বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।
“فَأَرَادَ أَنْ يُضَحِّيَ” (যে ব্যক্তি কুরবানী করার ইচ্ছা করবে) হাদীসে উল্লিখিত এ বাক্য দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, উপরোক্ত বিধান শুধুমাত্র কুরবানী দিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য।
২. আর যারা কুরবানী করবে না অর্থাৎ কুরবানী দিতে অক্ষম, তাদের কী করণীয়?
এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাযি. এর সূত্রে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে এসেছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দ্বীনি বিষয়ে জানতে এসেছিলেন। জওয়াব নিয়ে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আবার ডেকে বললেন,
أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ فَقَالَ الرَّجُلُ أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا مَنِيحَةَ أُنْثَى (و في رواية أحمد: مَنِيحَةَ اِبْنِي) أَفَأُضَحِّي بِهَا قَالَ لَا وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.
“আমি কুরবানীর দিনে ঈদ উদযাপন করতে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছি। মহান আল্লাহ এই দিনকে এ উম্মাহের জন্য ঈদ হিসাবে নির্দিষ্ট করেছেন। লোকটি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি মাদি মানীহা ছাড়া অন্য পশু না পাই (যা আমার নিজ মালিকানাধীন নয়) তাহলে তা দ্বারাই কুরবানী করব কি? তিনি বললেন: না, কিন্তু তুমি ঐ দিন তোমার চুল ও নখ কাটবে, মোচ খাটো করবে এবং নাভীর নীচের পশম মুণ্ডন করবে। এটাই আল্লাহর নিকট তোমার পরিপূর্ণ কুরবানী।” -শায়খ আহমাদ শাকের রহ. বলেন, বর্ণনাটির সনদ সহীহ। সুনানে নাসাঈ ২/১৭৯, হাদীস ৪৩৭৭, অধ্যায়- বাবু মান লাম্ ইয়াজিদিল্ উদহিয়্যাতা; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯১; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস ৭৫২৯; ইমাম হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৭৫, তাহকীক-শায়খ আহমাদ শাকের।
উল্লেখ্য, আরবের লোকেরা দুগ্ধবতী গাভী বা ভেড়া এ শর্তে কাউকে দান করত যে, প্রয়োজনীয় সময় দুধ পানের পর ফেরত দেবে। এই জাতীয় পশুকে ‘মানীহা’ বলা হত। -শরহুন নববী আলা সহীহ মুসলিম, ৭/১০৬
এ হাদীস দ্বারা এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তি কুরবানীর দিনে চুল, নখ প্রভৃতি কাটলে সে পূর্ণ কুরবানীর সওয়াব পাবে।
আল্লামা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রহ. এ হাদীসের বাক্য
“فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ”
এর ব্যাখ্যায় বলেন,
“أَيْ أَضْحِيَّتُكَ تَامَّةٌ بِنِيَّتِكَ الْخَالِصَةِ وَ لَكَ بِذَلِكَ مِثْلُ ثَوَابِ الْأُضْحِيَّةِ”
অর্থাৎ একনিষ্ঠ নিয়তের কারণে, (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিধান অনুযায়ী কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তির কুরবানীর দিনে চুল, নখ প্রভৃতি কাটা) এটা পূর্ণাঙ্গ কুরবানীর অনুরূপ বলে বিবেচিত হবে এবং এর দ্বারা সে কুরবানীর মতো সওয়াব পাবে। -বযলুল মাজহুদ: ৯/৫৩৩, হাদীস ২৭৮৯
আবুল হাসান সিন্দী রহ. “وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ …” অংশের ব্যাখ্যায় বলেন,
“كَأَنَّهُ أَرْشَدَهُ إِلَى أَنْ يُّشَارِكَ الْمُسْلِمِيْنَ فِيْ الْعِيْدِ وَالسُّرُوْرِ وَ إِزَالَةِ الْوَسْخِ فَذَاكَ يَكْفِيْهِ إِذَا لَمْ يَجِدِ الْأُضْحِيَّةَ.”
অর্থাৎ উক্ত ব্যক্তির প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা এমন ছিল যে, সে মুসলিমদের সাথে ঈদের আনন্দে অংশ নেবে এবং পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করবে; আর কুরবানী দেওয়ার সামর্থ্য না থাকা অবস্থায় এটাই তার জন্য যথেষ্ট হবে। – সুনানে নাসাঈ ২/১৭৯, হাদীস ৪৩৭৭ এর টীকা।
৩. তবে কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তি কবে থেকে চুল, নখ প্রভৃতি কাটা থেকে বিরত থাকবে?
এ ব্যাপারে হাদীসে কিছুই বলা হয়নি। পূর্ণাঙ্গ কুরবানীর সওয়াব পাওয়ার জন্য কুরবানী দিতে সক্ষম ব্যক্তির মতো যিলহজ্ব মাসের শুরু থেকে এগুলো কর্তন থেকে বিরত থাকতে হবে কি না, এ সংক্রান্ত কোনো শর্তও হাদীসে উল্লেখ নেই। বরং হাদীসে শর্তহীন ও সাধারণভাবে কুরবানীর দিনে চুল, নখ প্রভৃতি কর্তন করতে বলা হয়েছে।
উপরিউক্ত পর্যালোচনা থেকে এটা প্রতিভাত হয় যে, কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তির জন্য যিলহজ্ব মাসের শুরু থেকে চুল, নখ প্রভৃতি কাটা থেকে বিরত থাকা শর্ত নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ কুরবানীর সওয়াব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শুধু কুরবানীর দিনে এগুলো কাটলে তা তার জন্য যথেষ্ট হবে। উপরে উল্লিখিত সিন্দী রহ.-এর কথা থেকেও এমনটি ফুটে ওঠে। মহান আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত।
কোনো কোনো বইতে শর্তযুক্ত করে এভাবে বলা হয়েছে, ‘কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তি যদি কুরবানীর ঈদের চাঁদ ওঠার আগ থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত এগুলো কাটা থেকে বিরত থাকে, তবে সেও পূর্ণ একটি কুরবানীর সওয়াব পাবে।’ -যেমন: ফয়যুল কালাম, ২৪৭ পৃষ্ঠা, অনু: মাওলানা মুহাম্মাদ খালিদ সাইফুল্লাহ, মাকতাবায়ে এমদাদিয়া- ঢাকা। ‘ফয়যুল কালাম’ এর ঊর্দূ শরাহ ‘ফাতহুল মারাম’ এর ৩০৩ পৃষ্ঠা, মুফতী ইজহারুল ইসলাম, কুতুবখানা ফাইযিয়া, হাটহাজারী- চট্টগ্রাম।
উক্ত বইটিতে এ কথার স্বপক্ষে কোনো দলিল পেশ করা হয়নি; আর আমরাও তালাশ করে এ সংক্রান্ত কোনো বর্ণনা খুঁজে পাইনি।
৪. কুরবানীদাতা তার চুল-নখ ইত্যাদি পরবর্তীতে কখন কাটতে পারবে?
উল্লিখিত প্রথম হাদীস থেকে এটা বুঝে আসে যে, কুরবানীদাতা চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করার আগ পর্যন্ত চুল, নখ প্রভৃতি কাটবে না। বরং কুরবানী করার পর কাটবে। হাদীসটির মূল বক্তব্য নিম্নরূপ-
“مَنْ رَأَى هِلَالَ ذِي الْحِجَّةِ فَأَرَادَ أَنْ يُضَحِّيَ فَلَا يَأْخُذْ مِنْ شَعْرِهِ وَلَا مِنْ أَظْفَارِهِ حَتَّى يُضَحِّيَ”
যে ব্যক্তি যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখবে এবং কুরবানী করার মনস্থ করবে, সে যেন তার চুল ও নখের কোনো কিছু না কাটে।
কুরবানী করার পরপর কাটার বিষয়টি উপরে উল্লিখিত দ্বিতীয় হাদীস থেকে আরো স্পষ্ট হয়। সেখানে বলা হয়েছে, কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তি কুরবানীর দিনে চুল, নখ প্রভৃতি কাটলে সে পূর্ণ কুরবানীর সওয়াব পাবে। হাদীসটি হল-
أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا مَنِيحَةَ أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا قَالَ لَا وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللَّهِ ع