যাকাত সম্পর্কে তিনটি মাসআলা

প্রশ্ন-০১

যাকাতের আলোচনায় বলা হয়ে থাকে, কারও কাছে সাড়ে সাত ভরি সোনা কিংবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার কম থাকলে যদি সাথে নগদ ‘কিছু টাকা থাকে তাহলে সবগুলো মিলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার মূল্যমানের হলে ওই ব্যক্তিকে নেসাবের মালিক বলে গণ্য করা হবে।

আমার জানার বিষয় হলো, এখানে ‘কিছু টাকা’ দ্বারা সর্বনিম্ন কত টাকা উদ্দেশ্য? হাতখরচ বাবদ কিংবা হঠাৎ কোনো মেহমান আসতে পারে, কেউ অসুস্থ হতে পারে অথবা এমন কোনো কাজের জন্য দুই-চারশত টাকা তো সব সময় হাতে থাকেই।

প্রশ্ন-০২

বাজারে সোনা ও রূপার বিভিন্ন ক্যারেট ও গ্রেড থাকে এবং সে হিসাবে দামেও পার্থক্য থাকে। যাকাতের হিসাবের ক্ষেত্রে বাসায় থাকা সোনা অথবা রূপার মূল্যমান কত ক্যারেট হিসেবে নির্ধারণ করবো?

প্রশ্ন-০৩

একটি ওয়েব সাইটে ‘রোযা ও যাকাত: প্রচলিত কয়েকটি মাসআলা’ শিরোনামে ব্যবসায়ী পণ্যের যাকাত সম্পর্কে লিখা হয়েছে,

ব্যবসায়িক পণ্যের কোন মূল্য ধর্তব্য

টাকা-পয়সা ও স্বর্ণাংলকারের মতো ব্যবসায়িক পণ্য এবং ব্যবসার মূলধনেরও যাকাত দিতে হয়। ব্যবসায়ী যাকাত দেওয়ার সময় তার অবিক্রিত পণ্যের কোন মূল্যটি হিসাব করবে, খরিদ মূল্য, পাইকারি মূল্য, খুচরা মূল্য নাকি অন্য কোনো মূল্য?

এ প্রশ্নের জবাব হল, লোকটি তার অবিক্রিত পণ্যের বর্তমান বাজার দর হিসাব করে যাকাত আদায় করবে। অর্থাৎ যেদিন তার যাকাত-বর্ষ পুরো হয়েছে সেদিন তার ব্যবসায়িক পণ্যগুলো একত্রে বিক্রি করে দিলে যে দাম পাওয়া যেত, সে মূল্যের হিসাবে যাকাত প্রদান করবে।”

এখানে ‘সেদিন তার ব্যবসায়িক পণ্যগুলো একত্রে বিক্রি করে দিলে যে দাম পাওয়া যেত’ এটি কীভাবে নির্ধারণ করা হবে?

পাইকারি দামের একটা বাজার দর থাকে, খুচরা দামের আরেকটা বাজার দর থাকে যা ক্রেতা-বিক্রেতা অনুসারে সামান্য কমবেশি হতে পারে। কিন্তু ‘সেদিন তার ব্যবসায়িক পণ্যগুলো একত্রে বিক্রি করে দিলে যে দাম পাওয়া যেত’ এটি তো একটি অস্পষ্ট কথা। কারণ কেউ বিশেষ হালাত ছাড়া তার ব্যবসায়িক পণ্যগুলো একত্রে বিক্রি করে না। বিশেষ হালাত যেমন,

ক) কেউ বর্তমান ব্যবসাতে লাভের আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। তখন সে তার কেনা দামেই ছেড়ে দেবে অথবা সামান্য লস দিয়ে হলেও ছেড়ে দেবে।

খ) কেউ আরও বেশি লাভজনক কোনো ব্যবসা পেয়েছে, তখন সে সামান্য লাভে কিংবা সমানে সমানে ছেড়ে দিয়ে টাকা বের করে আনবে।

গ) বড় কোন বিপদ পড়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে।

এমন বিভিন্ন সুরত হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে কেউ তার ব্যবসায়িক পণ্যগুলো একত্রে বিক্রি করে না। এখন আমার জানার বিষয় হলো, ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্যের হিসাবটা কীভাবে করা হবে?

-মুহাম্মাদ আনাস

উত্তর-০১:

‘কিছু টাকা’ দ্বারা সর্বনিম্ম এক টাকাই উদ্দেশ্য, যা সাধারণত সবার কাছেই থাকে। তাই সোনা অথবা রূপার সাথে হাতখরচ কিংবা মেহমানদারি যে কোনো উদ্দেশ্যে রাখা ‘কিছু টাকা’ মিলিয়ে নেসাব পরিমাণ হলেও যাকাত দিতে হবে। -ফাতাওয়া উসমানী: ২/৭০ (মাকতাবাতু মাআরিফিল কুরআন, করাচি); ফাতাওয়া কাসিমিয়্যাহ: ১০/২৯০ (আশরাফিয়্যাহ বুক ডিপো, দেওবন্দ) কিতাবুন নাওয়াযিল: ৬/৭০ (আল-মারকাযুল ইলমী, মুরাদাবাদ)

উল্লেখ্য, নগদ অর্থ ও সোনা-রূপা; নিজের সম্ভাব্য প্রয়োজন, মেহমানদারি কিংবা চিকিৎসা কিংবা অন্য যে কোনো উদ্দেশ্যেই রাখা হোক না কেন, যাকাত বর্ষের দিন হাতে থাকলেই তা যাকাতের হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। হ্যাঁ, একমাত্র নিত্যপ্রয়োজনে গৃহীত ঋণ পরিশোধের জন্য রাখলে, সেটা যাকাতের হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে না।

উত্তর-০২:

এক্ষেত্রে আপনার বাসায় যে ক্যারেট/গ্রেডের সোনা/রূপা আছে, সেই ক্যারেট/গ্রেডের সোনা/রূপার বিক্রয় মূল্য তথা আপনি এখন তা বাজারে বিক্রি করলে যে মূল্য পাবেন, তা জেনে যাকাত হিসাব করবেন। সোনা-রূপা কোন ক্যারেট/গ্রেডের, তা জানা না থাকলে স্বর্ণকারদের দেখিয়ে জেনে নিতে পারেন অথবা সতর্কতা মূলক সবচেয়ে দামি ক্যারেট/গ্রেডের মূল্যও হিসাব করতে পারেন।-বাদায়েউস সানায়ে: ২/৪৮৩, (দারুল হাদীস); বানুরী টাউন ওয়েবসাইট, ফাতোয়া নং: ১৪৪২০৮২০১৩২৪, ১৪৩৯০৯২০০৩৪৩, ১৪৪৩০৮১০২২৮৬; কিতাবুন নাওয়াযেল: ৬/৫৫৯, (আলমারকাযুল ইলমী, লালবাগ, মুরাদাবাদ)।

উত্তর-০৩:

এখানে ফকিহদের একাধিক মতামত রয়েছে। যথা: ০১. পাইকারি বিক্রয়মূল্য। ০২. পাইকারি ব্যবসায়ীর জন্য পাইকারি বিক্রয় মূল্য এবং খুচরা ব্যবসায়ীর জন্য খুচরা বিক্রয় মূল্য।

পাইকারি মূল্য কোনটি, তাতেও ফকিহদের একাধিক মত রয়েছে। যথা: ০১. স্বাভাবিক পাইকারি বিক্রয় মূল্য। অর্থাৎ বর্তমান পাইকারি বাজারে এই মালগুলো যে মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। ০২. সবগুলো মাল একত্রে বিক্রি করলে যে মূল্য পাওয়া যাবে সে মূল্য। যেটাকে সাধারণত স্টক লট বিক্রি বলা হয় এবং যা সাধারণত স্বাভাবিক পাইকারি মূল্য থেকেও কম হয়।

উপর্যুক্ত যে কোনো মতের আলোকে মূল্য নির্ধারণ করে যাকাত দিলেই যাকাত আদায় হয়ে যাবে। তবে সতর্কতার দাবি ও উত্তম হল, পাইকারি বিক্রেতার জন্য বাজারে প্রচলিত স্বাভাবিক পাইকারি বিক্রয়মূল্য ধরা এবং খুচরা বিক্রেতার জন্য খুচরা বিক্রয়মূল্য ধরা। এতে সকলের মতেই যথাযথভাবে যাকাত আদায় হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। -ইমদাদুল ফাতাওয়া জাদীদ: ৪/২৬-২৭ (যাকারিয়া); ফাতাওয়া উসমানী: ২/৫৩ (মাকতাবা মাআরিফুল কুরআন করাচি); ফিকহী মাকালাত: ৩/১৫০ (মাইমান পাবলিশার্স); আলমাআইরুশ শরইয়্যাহ: ৪৭৭; কিতাবুন নাওয়াযিল: ৬/৫৬৮; ফাতাওয়া কাসেমিয়া: ১০/৪১৯

উল্লেখ্য, আপনি যে বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিভিন্ন দামে বিক্রির প্রসঙ্গটি এনে সংশয় তুলে ধরেছেন, ব্যক্তি বিশেষের এমন বিশেষ পরিস্থিতি এখানে ধর্তব্য নয়; বরং স্বাভাবিকভাবে এই মালগুলো সব একত্রে বিক্রি করলে তার মূল্য কত হতে পারে, সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের এমন অনুমান নির্ভর ধারণা উদ্দেশ্য। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় সুনির্দিষ্ট করা না গেলেও এমন ধারণা সব মহলের ব্যবসায়ীদেরই থাকে, যা বাস্তবতা থেকে খুব বেশি ব্যবধান হয় না।

মুফতি আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)

 

১৪-১২-২০২৪ ঈ.