উত্তরঃ
একাধিক স্ত্রীর মাঝে খাবার-দাবার, পোশাক-আশাক, বাসস্থান ইত্যাদিতে ইনসাফ এবং রাত্রিযাপনে সমতা রক্ষা করলে, শুধু সহবাসে কমবেশি করা গুনাহ নয়। তবে এক্ষেত্রেও সমান করা ভালো।
হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ (رضي الله عنها)، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقْسِمُ بَيْنَ نِسَائِهِ، فَيَعْدِلُ، وَيَقُولُ: «اللَّهُمَّ هَذِهِ قِسْمَتِي فِيمَا أَمْلِكُ، فَلَا تَلُمْنِي فِيمَا تَمْلِكُ وَلَا أَمْلِكُ». -سنن الترمذي ت شاكر (3/ 438)، الرقم: 1140
“আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীগণের মাঝে ইনসাফের সঙ্গে বণ্টন করতেন এবং বলতেন, হে আল্লাহ, এ হচ্ছে আমার আয়ত্তাধীন বিষয়ে আমার বণ্টন। যে বিষয় আমার আয়ত্তাধীন নয়; বরং তোমার আয়ত্তাধীন, তাতে তুমি আমাকে ভর্ৎসনা করো না।” -সুনানুত তিরমিযি, হাদীস নং: ১১৪০
হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী (রহ) (১০১৪ হি) বলেন,
)فيعدل) : أي: فيسوي بينهن في البيتوتة (ويقول) : أي مع هذا (اللهم هذا) : أي: هذا العدل (قسمي … فيما أملك) : أي: أقدر عليه (فلا تلمني) : أي: لا تعاتبني أو لا تؤاخذني (فيما تملك ولا أملك) : أي: من زيادة المحبة وميل القلب فإنك مقلب القلوب. -مرقاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح (دار الفكر): (5/ 2114)
“অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত্রিযাপনের ক্ষেত্রে স্ত্রীগণের মাঝে সমতা রক্ষা করতেন। এতদসত্ত্বেও তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! এই সমতা বিধান এমন বিষয়ে আমার বণ্টন, যে বিষয়ে আমি সক্ষম; সুতরাং আপনি আমাকে এমন বিষয়ে ভর্ৎসনা ও পাকড়াও করবেন না, যে বিষয়টি আমার সাধ্যের বাহিরে, যেমন (কোনো স্ত্রীর প্রতি) ভালোবাসা ও আকর্ষণ বেশি হওয়া। কারণ আপনিই তো অন্তরসমূহ পরিবর্তনকারী।” -মিরকাতুল মাফাতিহ: ৫/২১১৪
একই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনুল হুমাম (রহ) (৮৬২ হি) বলেন,
روى أصحاب السنن الأربعة عن عائشة – رضي الله عنها – قالت «كان رسول الله – صلى الله عليه وسلم – يقسم فيعدل ويقول: اللهم هذا قسمي فيما أملك فلا تلمني فيما تملك ولا أملك: يعني القلب» ….، ومنه عدد الوطآت والقبلات والتسوية فيهما غير لازمة إجماعا.اهـ. – فتح القدير: (3/411). ط. المكتبة الاشرفية. داكا.
“… যে বিষয়গুলো আয়ত্তাধীন নয়, তার মধ্যে রয়েছে, সহবাস ও চুমো ইত্যাদির পরিমাণ। সর্বসম্মতভাবেই এই বিষয়গুলোতে সমতা ওয়াজিব নয়।
তবে লক্ষ রাখতে হবে, অন্তরের অতিরিক্ত আকর্ষণের প্রভাব যেনো বাহ্যিক আচার-আচরণে এমনভাবে না পড়ে, যার ফলে অন্যের ওপর জুলুম হয়ে যায় এবং তার হক নষ্ট হয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন ,
وَلَنْ تَسْتَطِيعُوا أَنْ تَعْدِلُوا بَيْنَ النِّسَاءِ وَلَوْ حَرَصْتُمْ فَلَا تَمِيلُوا كُلَّ الْمَيْلِ فَتَذَرُوهَا كَالْمُعَلَّقَةِ. -النساء: 129
“তোমরা চাইলেও স্ত্রীদের মধ্যে পূর্ণ সমতা রক্ষা করতে পারবে না। তবে কোনো একজনের প্রতি সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না যে, অন্যজনকে ঝুলন্ত অবস্থায় ফেলে রাখবে।” -সূরা নিসা: ১২৯
অর্থাৎ সকলের প্রতি মনের টান সমান হবে না; বরং কারো প্রতি বেশি হবে, কারো প্রতি কম হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যাকে বেশি ভালো লাগে, তার প্রতি এমনভাবে ঝুঁকে পড়ো না যে, অন্যজনের প্রাপ্য হকও আদায় করবে না, আবার তালাকও দেবে না, যাতে সে অন্য স্বামী গ্রহণ করতে পারে। এভাবে ঝুলিয়ে রাখার অনুমতি নেই।
ইবনে কাসির (রহ) (৭৭৪ হি) বলেন,
أي: لن تستطيعوا أيها الناس أن تساووا بين النساء من جميع الوجوه، فإنه وإن حصل القسم الصوري: ليلة وليلة، فلا بد من التفاوت في المحبة والشهوة والجماع، كما قاله ابن عباس، وعبيدة السلماني، ومجاهد، والحسن البصري، والضحاك بن مزاحم. -تفسير ابن كثير ت سلامة (2/ 430(
“অর্থাৎ হে লোকসকল! তোমরা স্ত্রীদের মাঝে সর্বদিক থেকে সমতা বজায় রাখতে কখনো সক্ষম হবে না। কেননা (প্রত্যেকের নিকট) পালাক্রমে রাত্রিযাপন করার দ্বারা যদিও বাহ্যিক বণ্টন সম্ভবপর; কিন্তু ভালোবাসা, কামনা-বাসনা ও সহবাসের ক্ষেত্রে কমবেশি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যেমনটি ইবনে আব্বাস, উবাইদা, মুজাহিদ, হাসান বসরী ও দাহহাক ইবনে মুযাহিম (রা) উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেছেন।” -তাফসীরে ইবনে কাসির: ২/৪৩০
ইমাম তাবারী (রহ) (৩১০ হি) বলেন,
“فلا تميلوا كلَّ الميل”، يقول: فلا تميلوا بأهوائكم إلى من لم تملكوا محبته منهن كلَّ الميل، حتى يحملكم ذلك على أن تجوروا على صواحبها في ترك أداء الواجب لهن عليكم من حق: في القسم لهن، والنفقة عليهن، والعشرة بالمعروف. -تفسير الطبري = جامع البيان ت شاكر (9/ 284(
“অনিচ্ছাকৃত যদি কোনো স্ত্রীর প্রতি তোমাদের ভালোবাসা বেশি হয়ে যায়, তাহলেও তার প্রতি এতোটা ঝুঁকে পড়ো না যে, তা তোমাদেরকে অন্য স্ত্রীদের প্রতি জুলুম করার এবং সমহারে রাত্রিযাপন, ভরণপোষণ ও সদ্ভাবে জীবনযাপন ইত্যাদিতে তাদের হক আদায় না করার প্রতি প্ররোচিত করে।” -তাফসীরে তাবারী: ৯/২৮৪
এই ধরনের ব্যক্তিদের ব্যাপারেই নিম্নোক্ত ভয়ানক পরিণতির কথা হাদীসে এসেছে,
عن أبي هُريرة، عن النبيَّ – صلَّى الله عليه وسلم – قال: “مَن كانت له امرأتانِ، فمال إلى إحداهما جاء يَومَ القيامَةِ وشِقُّه مَائِلٌ”. -سنن أبي داود ت الأرنؤوط (3/ 469)، الرقم: 2133، قال الشيخ الأرنؤوط: إسناده صحيح. اهـ
“আবূ হুরাইরাহ (রাযি) থেকে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তির দুজন স্ত্রী থাকে, আর সে তাদের একজনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে, কেয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় উঠবে যে, তার অর্ধাংশ কাত হয়ে থাকবে।”-সুনানে আবু দাউদ: ৩/৪৬৯ হাদীস নং: ২১৩৩
উল্লেখ্য, সহবাসে কমবেশ করা যদিও নাজায়েয নয়, তবে কারো সঙ্গে এতো কম করা যাবে না, যাতে সে কষ্টের শিকার হয় এবং অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়; বরং মাঝে মাঝে সকল স্ত্রীর সাথেই সহবাস করতে হবে, যাতে সকলের চাহিদা পূরণ হয় এবং সতীত্ব ও পবিত্রতা সুরক্ষিত থাকে।” -ফাতহুল কাদীর: ৩/৪১৩
-আরও দেখুন মাবসূতে সারাখসি: ৫/২০৪; আলফাতাওয়াস সিরাজিয়্যাহ: ২০৬; ফাতাওয়া কাজিখান: ১/২৬১; হিদায়াহ: ১/৪০০; রদ্দুল মুহতার: ৩/২০১, ৪/৩৭৬; ফাতহুল কাদীর: ৩/৪১৩
আরও বিস্তারিত জানতে নিম্নোক্ত ফতোয়াটি দেখুন: একাধিক স্ত্রীর মাঝে ইনসাফ ও সমতা রক্ষার বিধান কী?
فقط، والله تعالى أعلم بالصواب.
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)
২১-১০-২০২৪ ঈ.
#উচ্চতর #ইসলামী #আইন #গবেষণা #বিভাগ #ফাতওয়া