বিনা অনুমতিতে পিতার ব্যবসা থেকে খরচ করার বিধান
প্রশ্নঃ
আমি বাবার ব্যবসায় সময় দিই। আমার আয়ের কোনো উৎস না থাকায় অনেক সময় বাবার ব্যবসা থেকে অনুমতি নিয়ে অথবা অনুমতি ব্যতীত নিজ প্রয়োজনে খরচ করি এবং দান সাদাকা করি। আমার প্রশ্ন হলো, আমি কি বিনা অনুমতিতে বাবার ইনকামের অংশ ব্যবহার করতে পারবো?
প্রশ্নকারী-আব্দুল্লাহ
উত্তরঃ
بسم الله الرحمن الرحيم
نحمده و نصلي على رسوله الكريم، أما بعد!
আপনার বাবার ব্যবসার সম্পদ আপনার নিকট আমানত। মালিকের অনুমতি ব্যতীত আমানতের সম্পদে হস্তক্ষেপ করা জায়েয নয়। সুতরাং অনুমতি ব্যতীত আপনার বাবার ব্যবসার আয়ের অংশ ব্যবহার করা আপনার জন্য বৈধ নয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“فَإِنْ أَمِنَ بَعْضُكُمْ بَعْضًا فَلْيُؤَدِّ الَّذِي اؤْتُمِنَ أَمَانَتَهُ وَلْيَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ”. -البقرة: 283
“আর যদি তোমাদের একে অন্যকে বিশ্বাস করে, তবে যাকে বিশ্বাস করা হয়েছে, সে যেন তার আমানত পুরোপুরি আদায় করে এবং তার রব আল্লাহকে ভয় করে।” –সূরা বাকারা ০২:২৮৩
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: يَأْكُلُ الرَّجُلُ مِنْ مَالِ وَلَدِهِ مَا شَاءَ، وَلاَ يَأْكُلُ الْوَلَدُ مِنْ مَالِ وَالِدِهِ إلاَّ بِإِذْنِهِ. -مصنف ابن أبي شيبة 11/ 530، الرقم: 23146، كتاب البيوع و الأقضية، باب في الرجل يأخذ من مال ولده، ط. شركة دار القبلة
“আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, পিতা সন্তানের সম্পদ থেকে যা ইচ্ছা ভক্ষণ করতে পারবে। সন্তান পিতার সম্পদ থেকে তাঁর অনুমতি ব্যতীত ভক্ষণ করতে পারবে না।”–মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা ১১/৫৩৩, আসার নং ২৩১৪৬, মুদ্রণঃ দারুল কিবলা ও মুআসসাসাতু উলূমিল কুরআন
)سئل) : في رجل ساكن في بيت أبيه في جملة عياله وصنعتهما متحدة يعينه بتعاطي أموره ولا يعرف للابن مال سابق فاجتمع مال بكسبه ويريد أن يختص به بدون وجه شرعي فهل جميع ما حصله بكسبه ملك لأبيه ولا شيء له فيه؟
(الجواب) : نعم جميع ما حصله بكسبه ملك لأبيه لا شيء له فيه حيث كان من جملة عياله والمعين له في أموره وأحواله وصنعتهما متحدة ولا يعرف للابن مال سابق؛ لأن الابن إذا كان في عيال الأب يكون معينا له فيما يصنع كما صرح بذلك في الخلاصة والبزازية ومجمع الفتاوى وأفتى بذلك الخير الرملي. – العقود الدرية في تنقيح الفتاوى الحامدية (2/ 17)، كتاب الدعوى
“সুওয়ালঃ জনৈক ব্যক্তি স্বীয় পিতার ঘরে পিতার সংসারে যৌথ পরিবারে থাকে। তাদের (পিতা-পুত্রের) পেশা এক ও অভিন্ন। পেশাগত কাজে সে পিতাকে সহযোগিতা করে। পেশা শুরুর পূর্বে ছেলের কোনো সম্পদ ছিলো বলে জানা নেই। অতঃপর (ওই পেশা হতে) তার শ্রমের মাধ্যমে তার হাতে কিছু সম্পদ আসে। শরয়ী কোনো কারণ ছাড়াই সে একা তা নিয়ে নিতে চাচ্ছে। (প্রশ্ন হলো, উক্ত পেশায়) নিজ চেষ্টা-শ্রম ব্যয়ে সে যা কিছু উপার্জন করেছে এর সবই কি তার বাবার মালিকানায় চলে যাবে এবং তা থেকে কিছুই কি সে পাবে না?
জওয়াবঃ হ্যাঁ, যেহেতু সে তার বাবার সংসারের অধীন, তার কার্যাদিতে তার সহযোগী, তাদের পেশা অভিন্ন এবং পেশা শুরুর পূর্বে ছেলের কোনো সম্পদও ছিলো না, তাই নিজ চেষ্টা-শ্রম ব্যয়ে (উক্ত পেশা হতে) সে যা কিছু উপার্জন করেছে, সমুদয়ের মালিকানা তার বাবার, এতে তার কোনও অংশ নেই। কেননা ছেলে যখন বাবার সংসারের অধীন থাকে তখন বাবার পেশায় তাকে বাবার সহযোগী ধরা হয়; যেমনটি খুলাসা, বাযযাযিয়া ও মাজমাউল ফাতাওয়ায় সুস্পষ্ট বলা হয়েছে এবং আল্লামা খায়ের রামালি রহিমাহুল্লাহ এই ফতোয়াই প্রদান করেছেন।” -আলউকুদুদ দুররিয়্যাহ ফি তানকিহিল ফাতাওয়াল হামিদিয়্যাহ ২/২৮, মুদ্রণঃ মাকতাবায়ে আশরাফিয়া, পাকিস্তান, আরও দেখুন আদ্দুররুল মুখতার: ৫৬৭; রদ্দুল মুহতার: ৫/৬৮৮, ৭০৯
হ্যাঁ, দান-সাদাকা করা কিংবা নিজ প্রয়োজনে খরচ করার ক্ষেত্রে যতটুকুতে আপনার বাবার সুস্পষ্ট অথবা মৌন অনুমতি থাকবে (মৌন অনুমতি এভাবে ধরা যাবে যে, তিনি যদি এতটুকু খরচ কিংবা দান করা হয়েছে জানেন, তাহলে কষ্ট পাবেন না, বরং সন্তুষ্ট চিত্তে অনুমতি দিবেন তাহলে), ততটুকু নিতে পারবেন এবং দান করতে পারবেন। এর অতিরিক্ত পারবেন না। সুস্পষ্ট কিংবা মৌন অনুমতি সাপেক্ষে যতটুকু দান করবেন, ততটুকুতে আপনিও সাওয়াব পাবেন, আপনার পিতাও সাওয়াব পাবেন। হাদীসে এ বিষয়টিতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
عن عائشة رضي الله عنها قالت : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم “إذا أنفقت المرأة من طعام بيتها غير مفسدة كان لها أجرها بما أنفقت ولزوجها أجره بما كسب وللخازن مثل ذلك لا ينقص بعضهم أجر بعض شيئا”. -صحيح البخاري، الرقم: 1359، كتاب الزكاة، باب من أمر خادمه بالصدقة ولم يناول بنفسه، ط. دار ابن كثير ، اليمامة – بيروت
“আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন কোনো নারী সীমালঙ্ঘন ব্যতীত ঘরের খাবার-দাবার থেকে দান-সাদাকা করে (যতটুকুতে স্বামীর স্বাভাবিক অনুমতি থাকে), তখন সে এর প্রতিদান প্রাপ্ত হয় সাদাকা করার কারণে। তার স্বামীও প্রতিদান প্রাপ্ত হয় উপার্জন করার কারণে এবং (এ সম্পদ) রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যার হাতে ছিলো সে-ও ওই পরিমাণ প্রতিদান প্রাপ্ত হয়। কেউ কারও প্রতিদানে সামান্যতমও হ্রাস করে না।” -সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩৫৯
ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ (৬৭৬ হি.) বলেন,
واعلم أنه لا بد للعامل وهو الخازن وللزوجة والمملوك من إذن المالك في ذلك فإن لم يكن إذن أصلا فلا أجر لأحد من هؤلاء الثلاثة بل عليهم وزر بتصرفهم في مال غيرهم بغير إذنه والإذن ضربان أحدهما الإذن الصريح في النفقة والصدقة والثاني الإذن المفهوم من اطراد العرف والعادة كإعطاء السائل كسرة ونحوها مما جرت العادة به واطرد العرف فيه وعلم بالعرف رضاء الزوج والمالك به فإذنه في ذلك حاصل وإن لم يتكلم وهذا إذا علم رضاه لاطراد العرف وعلم أن نفسه كنفوس غالب الناس في السماحة بذلك والرضا به فإن اضطرب العرف وشك في رضاه أو كان شخصا يشح بذلك وعلم من حاله ذلك أو شك فيه لم يجز للمرأة وغيرها التصدق من ماله إلا بصريح إذنه.
وأما قوله صلى الله عليه وسلم (وما أنفقت من كسبه من غير أمره فإن نصف أجره له) فمعناه من غير أمره الصريح في ذلك القدر المعين ويكون معها إذن عام سابق متناول لهذا القدر وغيره وذلك الاذن الذي قد بيناه سابقا اما بالصريح واما بالعرف. … واعلم أن هذا كله مفروض في قدر يسير يعلم رضا المالك به في العادة فإن زاد على المتعارف لم يجز. – شرح النووي على مسلم (7/ 112)، ط. دار إحياء التراث العربي – بيروت
“স্মর্তব্য, কর্মচারী তথা পূর্বোক্ত হাদীসে যাকে খাযেন তথা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বশীল বলা হয়েছে, তার জন্য এবং স্ত্রী ও দাস-দাসীর জন্য (দান-সাদাকা করা কিংবা নিজ প্রয়োজনে খরচ করার ক্ষেত্রে) মালিকের অনুমতি আবশ্যক। যদি মোটেই কোনও ধরনের অনুমতি না থাকে, তাহলে এই তিন জনের কারোই সাওয়াব হবে না; বরং অনুমতি ছাড়া অন্যের সম্পদে হস্তক্ষেপ করার কারণে তারা গুনাহগার হবে।
অনুমতি দুই ধরনের। এক. খরচ ও দান করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট অনুমতি; দুই. ওরফ ও আদত তথা সমাজের স্বাভাবিক প্রচলন ও রীতি-নীতি নির্ভর অনুমতি। যেমন ভিক্ষুককে এক টুকরা রুটি কিংবা এমন সামান্য কিছু দান করা; যেটি সমাজে প্রচলিত আছে এবং সমাজের স্বাভাবিক প্রচলন হিসেবে এতটুকু দান করা তথা খরচ করার বিষয়ে স্বামী ও মালিকের মর্জি আছে বলে জানা আছে। তাই এ ক্ষেত্রে তার অনুমতি আছে ধরা হবে যদিও মৌখিকভাবে কিছু বলেনি।
উপর্যুক্ত এই বিধান তখন প্রযোজ্য হবে, যখন সামাজিক প্রচলনের দরুন তার সন্তুষ্টি আছে বুঝা যাবে এবং বুঝা যাবে যে, সমাজের অন্য দশ জনের মতোই এতটুকু খরচের ব্যাপারে তিনি উদারচিত্ত। যদি সমাজের প্রচলনে কম বেশ থাকে এবং মালিকের মর্জি আছে কি না তাতে সন্দেহ রয়ে যায়, কিংবা লোকটি এমন যে, তার অবস্থাদৃষ্টে জানা আছে যে, এইটুকুর ব্যাপারে সে কার্পণ্য দেখাবে কিংবা অন্তত এ ব্যাপারে সন্দেহ বাকি থাকে, তাহলে স্ত্রী অথবা অন্য কারও জন্য সুস্পষ্ট অনুমতি ব্যতীত তার সম্পদ থেকে দান করা জায়েয হবে না।
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বলেছেন, ‘স্বামীর উপার্জন থেকে অনুমতি ছাড়া যা কিছু স্ত্রী ব্যয় করবে, তার অর্ধেক প্রতিদান স্বামী পাবে’ -এর উদ্দেশ্য হলো, এই নির্দিষ্টি পরিমাণটি দান করার ক্ষেত্রে স্বামীর সুস্পষ্ট অনুমতি নেয়নি ঠিক, কিন্তু এই পরিমাণ বা তার চেয়ে কম-বেশ দান করার ব্যাপারে এক রকম ব্যাপক অনুমতি আগে থেকেই আছে। যেটির কথা আগে বলেছি যে, হয় সুস্পষ্ট অনুমতি আছে বা সামাজিক প্রচলন থেকে বুঝা যাচ্ছে।
আরও স্মরণ রাখতে হবে যে, উপর্যুক্ত সকল কথা টুকটাক জিনিসের ব্যাপারে প্রযোজ্য, যতটুকুর ব্যাপারে সাধারণত মালিকের সন্তুষ্টি আছে বলে বুঝা যায়। এর চেয়ে বেশি হলে জায়েয হবে না।” -শরহে নববী আলা সহীহি মুসলিম ৭/১১২, মুদ্রণঃ দারু ইহইয়ায়িত তুরাসিল আরাবি, বৈরুত
فقط، والله تعالى أعلم بالصواب
মুফতি আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আলমাহদি (উফিয়া আনহু)
১৬-১২-২০২৪ ঈ.