জি-যি-য়ার পরিচয় ও তার হুকুম

প্রশ্ন: জি-যি-য়া অর্থ কী? জি-যি-য়া কাদের থেকে উসুল করা হয়? শুনেছি, মুসলিম ও কা-ফে-র একসাথে বসবাস করতে পারে না। তারা হয় ইসলাম গ্রহণ করবে, না হয় জি-যি-য়া দিতে সম্মত হবে, না হয় ত-র-বা-রি-র মাধ্যমে ফায়সালা হবে। কথাটি সহীহ কী না? কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিস্তারিত জানানোর অনুরোধ করছি।

-আবু উবাইদা

উত্তর: জি-যি-য়া অর্থ বিনিময়, বদলা। অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপদে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ প্রদানের বিনিময়ে, ইমামুল মুসলিমীন তাদের থেকে যে অর্থ গ্রহণ করেন, তাকে জি-যি-য়া বলা হয়। -আল-মুফরদাত, রাগেব ইস্পাহানী, পৃ: ১৯৫; তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত, ইমাম নববী: ৩/৫১ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ); লিসানুল আরব: ১৪/১৪৭ (দারু সাদির); ফাতহুল কাদীর: ৬/৪৪ (দারুল ফিকর); রদ্দুল মুহতার: ৪/১৯৬ (দারুল ফিকর) আল-মুগনী: ৯/৩২৮ (মাকতাবাতুল কাহেরাহ); আকরাবুল মাসালিক, ইমাম দারদীর মালেকী: ২/৩০৮-৩০৯

মু-র-তা-দ ও জাযীরাতুল আরবের মু-শ-রি-ক ছাড়া অন্য সকল কা-ফে-রে-র সাথে জি-যি-য়া চুক্তি করা যায়। এক্ষেত্রে কা-ফে-র-দে-র মধ্য হতে যু-দ্ধ করতে সক্ষম এমন সুস্থ মস্তিষ্ক, বালেগ, স্বাধীন পুরুষদের থেকে ধনী-গরীব ভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণে জি-যি-য়া গ্রহণ করা হবে। নারী, শিশু ও যুদ্ধ করতে সক্ষম নয় এমন পুরুষদের থেকে জি-যি-য়া নেয়া যাবে না। -আলহিদায়াহ: ২/৪০১ (দারু ইহয়ায়িত তুরাস); আল-বাহরুর রায়েক: ৫/১১৯ (দারুল কিতাবিল ইসলামী); রদ্দুল মুহতার: ৪/১৯৯ (দারুল ফিকর)

মুসলিমরা শক্তিশালী থাকাবস্থায় হা-র-বী কা-ফে-র-দে-র তিনটি বিষয়ে ইখতিয়ার দিবে। হয় তারা ইসলাম গ্রহণ করবে, নতুবা জি-যি-য়া প্রদানের শর্তে ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত হয়ে থাকবে। অন্যথায় তরবারির মাধ্যমে তাদের সাথে ফায়সালা হবে।

শক্তি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ না করে কা-ফে-র-দের এমনি ছেড়ে রাখা এবং মুসলিম-কা-ফে-র পরস্পরের তথাকথিত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করা জায়েয নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ. -التوبة: 29

“কিতাবীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন, তা হারাম হিসেবে মানে না এবং সত্য দীনকে দীন হিসেবে গ্রহণ করে না, তাদের সঙ্গে যু-দ্ধ করো, যতক্ষণ না তারা লাঞ্ছিত ও অপদস্থ অবস্থায় নিজ হাতে জি-যি-য়া প্রদান করে।” -সূরা তাওবা ০৯:২৯

বুরাইদা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا أمر أميرا على جيش، أو سرية، أوصاه في خاصته بتقوى الله، ومن معه من المسلمين خيرا، ثم قال: «اغزوا باسم الله في سبيل الله، قاتلوا من كفر بالله، اغزوا ولا تغلوا، ولا تغدروا، ولا تمثلوا، ولا تقتلوا وليدا. وإذا لقيت عدوك من المشركين، فادعهم إلى ثلاث خصال – أو خلال – فأيتهن ما أجابوك فاقبل منهم، وكف عنهم، ثم ادعهم إلى الإسلام، فإن أجابوك، فاقبل منهم، وكف عنهم، … فإن هم أبوا فسلهم الجزية، فإن هم أجابوك فاقبل منهم، وكف عنهم، فإن هم أبوا فاستعن بالله وقاتلهم. –صحيح مسلم (3/1357 رقم: 1731 ط. دار إحياء التراث)

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো বড় সেনাদল কিংবা ছোট সেনাদলের আমীর নিযুক্ত করতেন, তখন বিশেষ করে তাঁকে আল্লাহর ভয় অবলম্বন এবং তাঁর সঙ্গী মুসলমানদের প্রতি সদাচারের উপদেশ দিতেন। অতঃপর বলতেন, যু-দ্ধ করো আল্লাহর নামে, আল্লাহর রাস্তায়। কি-তা-ল করো তাদের বিরুদ্ধে, যারা আল্লাহর সঙ্গে কু-ফ-রী করেছে। যু-দ্ধ করো, তবে (গ-নী-ম-তে-র মালের) খি-য়া-ন-ত করো না, চুক্তি ভঙ্গ করো না, শক্র পক্ষের অঙ্গ বিকৃতি করো না। শিশুদেরকে হত্যা করো না।

যখন তুমি মু-শ-রি-ক শ-ক্র-র সম্মুখীন হবে, তখন তাকে তিনটি বিষয়ের প্রতি আহ্বান জানাবে। তারা এগুলোর মধ্য থেকে যেটাই গ্রহণ করবে, তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবে। প্রথমে তাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিবে। যদি তারা তোমার এই আহ্বানে সাড়া দেয়, তবে তুমি তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যু-দ্ধ করা থেকে বিরত থাকবে।… আর যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে তবে তাদেরকে জি-যি-য়া প্রদানের আহ্বান করবে। যদি তারা তাতে সাড়া দেয়, তবে তুমি তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকবে। আর যদি তারা এ দাবি না মানে, তবে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং তাদের বিরুদ্ধে কি-তা-ল (শুরু) করো…।” –সহীহ মুসলিম: ৩/১৩৫৭ হাদীস: ১৭৩১ (দারু ইহয়ায়িত তুরাস)

নাহাওয়ান্দ যুদ্ধের দিন মুগীরা বিন শোবা রাযিয়াল্লাহু আনহু পারস্যের বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

أمرنا نبينا رسول ربنا صلى الله عليه وسلم أن نقاتلكم حتى تعبدوا الله وحده، أو تؤدوا الجزية. وأخبرنا نبينا صلى الله عليه وسلم عن رسالة ربنا، أنه من قتل منا صار إلى الجنة في نعيم لم ير مثلها قط، ومن بقي منا ملك رقابكم. -صحيح البخاري (4/ 97 رقم: 3159 ط. دار طوق النجاة)

“আমাদের নবী, আমাদের রবের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আদেশ করেছেন, তোমাদের বিরুদ্ধে যু-দ্ধ করতে; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করবে কিংবা জি-যি-য়া প্রদান করবে এবং আমাদের নবী তাঁর রবের পক্ষ হতে আমাদের জানিয়েছেন, আমাদের যারা (তোমাদের বিরুদ্ধে যু-দ্ধে) শ-হী-দ হবে, তারা জান্নাতে এমন নেয়ামত ভোগ করবে, যা কেউ কখনো দেখেনি। আর যারা জীবিত থাকবে, তারা তোমাদের গ-র্দা-নের মালিক হয়ে যাবে।” –সহীহ বুখারী: ৪/৯৭ হাদীস: ৩১৫৯ (দারু তাওকিন নাজাহ)

আবু ওয়ায়েল রহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন,

عن أبي وائل قال: كتب خالد بن الوليد إلى أهل فارس يدعوهم إلى الإسلام: «بسم الله الرحمن الرحيم من خالد بن الوليد إلى رستم ومهران، وملأ فارس سلام على من اتبع الهدى، أما بعد فإنا ندعوكم إلى الإسلام، فإن أبيتم فأعطوا الجزية عن يد وأنتم صاغرون، فإن أبيتم، فإن معي قوما يحبون القتل في سبيل الله كما تحب فارس الخمر. والسلام على من اتبع الهدى» -مصنف ابن أبي شيبة (18/259 رقم:34422 ط. دار القبلة) مسند ابن الجعد (ص: 335 رقم: 2304 ط. مؤسسة نادر – بيروت) المعجم الكبير للطبراني (4/ 105 رقم: 3806 ط. مكتبة ابن تيمية – القاهرة)

قال الهيثمي في “مجمع الزوائد” (5/ 310 ط. مكتبة القدسي) : وإسناده حسن أو صحيح.

“খালেদ বিন ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে পারস্যবাসীর নিকট চিঠি লিখেন। (চিঠির ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ)

বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম

খালেদ বিন ওয়ালীদের পক্ষ থেকে রুস্তম, মেহরান ও পারস্যের নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিদের প্রতি! শান্তি বর্ষিত হোক হেদায়াতের অনুসারীদের উপর। হামদ ও সালাতের পর আমরা তোমাদের ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। যদি তোমরা এতে সম্মত না হও তবে লাঞ্ছিত হয়ে জি-যি-য়া প্রদান করো। যদি এতেও সম্মত না হও তবে (জেনে রেখো) আমার সাথে এমন জাতি আছে, যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হতে তেমনই পছন্দ করে, যেমন পারস্যবাসী মদ পছন্দ করে। শান্তি বর্ষিত হোক হেদায়াতের অনুসারীদের উপর।” -সহীহ ইবনুল জাদ, পৃ: ৩৩৫ বর্ণনা নং: ২৩০৪ (মুআসসাতু নাদের); মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবাহ: ১৮/২৫৯ বর্ণনা নং: ৩৪৪২২ (দারুল কিবলাহ); আল-মুজামুল কাবীর: ৪/১০৫ বর্ণনা নং: ৩৮০৬ (মাকতাবাতু ইবনি তাইমিয়াহ)

হাফেয নুরুদ্দীন হাইসামী (৮০৭ হি.) বলেন, ‘এর সনদ হাসান বা সহীহ।’ –মাজমাউয যাওয়ায়েদ: ৫/৩১০ (মাকতাবাতুল কুদসী)

কাদেসিয়ার যুদ্ধের পূর্বে পারস্যের সেনাপতি রুস্তমের দরবারে দূত হিসেবে রিবয়ী বিন আমের রাযিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠানো হয়। ইবনে জারীর তাবারী (৩১০ হি.) এর বর্ণনায় তাদের কথোপকথনের চিত্র দেখুন,

فقال: ما جاء بكم؟ قال: الله ابتعثنا، والله جاء بنا لنخرج من شاء من عبادة العباد إلى عبادة الله، ومن ضيق الدنيا إلى سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام، فأرسلنا بدينه إلى خلقه لندعوهم إليه، فمن قبل منا ذلك قبلنا ذلك منه ورجعنا عنه، وتركناه وأرضه يليها دوننا، ومن أبى قاتلناه أبدا، حتى نفضي إلى موعود الله. قال: وما موعود الله؟ قال: الجنة لمن مات على قتال من أبى، والظفر لمن بقي فقال رستم: قد سمعت مقالتكم، فهل لكم أن تؤخروا هذا الأمر حتى ننظر فيه وتنظروا! قال: نعم، كم أحب إليكم؟ أيوما أو يومين؟ قال: لا بل حتى نكاتب أهل رأينا ورؤساء قومنا وأراد مقاربته ومدافعته، فقال: إن مما سن لنا رسول الله ص وعمل به أئمتنا، ألا نمكن الأعداء من آذاننا، ولا نؤجلهم عند اللقاء أكثر من ثلاث، فنحن مترددون عنكم ثلاثا، فانظر في أمرك وأمرهم، واختر واحدة من ثلاث بعد الأجل، اختر الإسلام وندعك وأرضك، أو الجزاء، فنقبل ونكف عنك، وإن كنت عن نصرنا غنيا تركناك منه، وإن كنت إليه محتاجا منعناك أو المنابذة في اليوم الرابع تاريخ الطبري (3/ 520 ط. دار التراث)

“রুস্তম জিজ্ঞাসা করলো, তোমরা কেন এসেছো? রিবয়ী বললেন, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে উত্থিত করেছেন, যেন আল্লাহ তাআলার যাদেরকে চান তাদেরকে সৃষ্টির গোলামি থেকে মুক্ত করে আল্লাহ তাআলার ইবাদতের দিকে, দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে প্রশস্ততার দিকে এবং সকল ধর্মের অবিচার থেকে উদ্ধার করে ইসলামের ইনসাফের দিকে নিয়ে যান। যারা আমাদের এই আহ্বান (অর্থাৎ ইসলাম) গ্রহণ করবে, আমরাও তাদের থেকে তা গ্রহণ করে ফিরে যাবো